০৫ আগষ্টের পর টক অফ দ্যা কান্ট্রি.
পিআর নির্বাচন পদ্ধতি, পিআর পদ্ধতির সুবিধা-অসুবিধা কি কি?

- আপডেট সময় : ০৯:২৮:০৯ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ২ অক্টোবর ২০২৫ ৪৪ বার পড়া হয়েছে

বিশেষ প্রতিনিধি :
শেখ হাসিনা পতনের পর নির্বাচন নিয়ে যত আলোচনা সমালোচনা হয়েছে তার থেকে জোরে শোরে পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের কথা উচ্চারিত হয়েছে।তাই প্রথমেই দেখা যাক পি আর পদ্ধতির নির্বাচন কি? তার সুবিধা – অসুবিধা গুলি কি?
প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে, বড় দুই রাজনৈতিক দল— বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামী পিআর বা আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মুখোমুখি অবস্থানে দাঁড়িয়ে আছে। জামায়াত, ইসলামী আন্দোলন, খেলাফত মজলিসের মতো ইসলামপন্থি দলগুলো পিআর ইস্যুতে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় সভা-সমাবেশ চালিয়ে চাচ্ছে। বিএনপি ও তাদের যুগপৎ আন্দোলনের সঙ্গী দলগুলোর পিআর পদ্ধতির বিপক্ষে।
দেশের ক্ষুদ্র দলগুলো দাবি তুলছে, পিআর ব্যবস্থা চালু হলে তাদের জন্য সংসদে প্রবেশের সুযোগ তৈরি হবে। তবে বিএনপির মতো বড় দলগুলো আশঙ্কা করছে— এতে স্থিতিশীল সরকার গঠনের ক্ষেত্রে জটিলতা দেখা দিতে পারে।
পিআর পদ্ধতি কী?
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব বা পিআর পদ্ধতি গণতান্ত্রিক নির্বাচন ব্যবস্থার একটি বহুল আলোচিত মডেল। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে এ পদ্ধতি চালু রয়েছে।
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব ব্যবস্থায় ভোট ও আসনের মধ্যে সরাসরি অনুপাত তৈরি করা হয়। একটি দল যে শতাংশ ভোট পায়, সংসদে তাদের আসনসংখ্যাও সেই অনুপাতে নির্ধারিত হয়। যেমন—একটি সংসদে যদি মোট ৩০০ আসন থাকে এবং কোনো দল ৩০ শতাংশ ভোট পায়, তবে তারা সংসদে প্রায় ৯০টি আসন পাবে। এতে কোনো ভোট ‘অপচয়’ হয় না, অর্থাৎ প্রতিটি ভোট সংসদে প্রভাব ফেলে।
পৃথিবীর কোন কোন দেশে পিআর ব্যবস্থা চালু
পৃথিবীর বহু দেশেই পিআর ব্যবস্থার বিভিন্ন রূপ কার্যকর রয়েছে। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো—
ইউরোপ: জার্মানি, নেদারল্যান্ডস, সুইডেন, নরওয়ে, স্পেন, গ্রিস, ইতালি।
এশিয়া: ইসরাইল, নেপাল, শ্রীলংকা।
আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকা, নামিবিয়া, অ্যাঙ্গোলা।
লাতিন আমেরিকা: ব্রাজিল, আর্জেন্টিনা, চিলি, উরুগুয়ে।
ওশেনিয়া: নিউজিল্যান্ড।
তবে বিভিন্ন দেশে এর প্রয়োগও ভিন্ন। যেমন—জার্মানিতে মিশ্র পদ্ধতি রয়েছে, যেখানে ভোটাররা একদিকে সরাসরি প্রার্থীকে ভোট দেন, আবার দলকেও ভোট দেন। সংসদে আসন বণ্টন হয় এ দুটি হিসাব মিলিয়ে। অন্যদিকে ইসরাইল পুরোপুরি পিআরভিত্তিক নির্বাচন পরিচালনা করে, যেখানে কোনো সংসদ সদস্য সরাসরি নির্বাচিত হন না—বরং দলীয় তালিকা থেকে আসন পূরণ করা হয়।
পিআর পদ্ধতির সুবিধা
১. প্রতিনিধিত্বের বিস্তার: ছোট দল ও সংখ্যালঘু গোষ্ঠী সংসদে প্রবেশের সুযোগ পায়।
২. ভোটের সঠিক প্রতিফলন: জনগণের দেওয়া ভোটের শতকরা হার আসনে প্রতিফলিত হয়, ফলে ভোটের অপচয় কমে।
৩. বহুমত সহাবস্থান: সংসদে নানা মতাদর্শের সহাবস্থান ঘটে, যা গণতন্ত্রকে বহুমাত্রিক করে।
৪. ভোটার অংশগ্রহণ বেশি: প্রতিটি ভোটের মূল্য আছে বলে মানুষ ভোট দেওয়ার প্রতি উৎসাহিত হয়।
পিআর পদ্ধতির অসুবিধা
১. ভঙ্গুর সরকার: সাধারণত কোনো একক দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায় না, ফলে বারবার জোট সরকার গঠন করতে হয়। এছাড়া দলগুলোর মধ্যে মতের মিল না হলে সবসময় সরকার ভেঙে যাওয়ার একটি আশঙ্কা থাকে।
২. ছোট দলের অতিরিক্ত প্রভাব: সংসদে কম সংখ্যক আসন থাকা দলগুলোও সরকার গঠনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যা অনেক সময় জটিলতা তৈরি করে।
৩. সিদ্ধান্ত গ্রহণে ধীরগতি: নানা মতাদর্শের কারণে সংসদে সিদ্ধান্তে পৌঁছানো কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে কোন আইন প্রণয়ন করতেও দীর্ঘ সময় লেগে যায় বা অনেক সময় তা সম্ভব-ই হয় না।
৪. জনগণের সঙ্গে এমপিদের দুর্বল সম্পর্ক: সরাসরি ভোটে নির্বাচিত এমপির মতো জনগণের সঙ্গে এমপিদের সম্পর্ক সবসময় দৃঢ় থাকে না। এলাকার চেয়ে দলের প্রতি তাদের দায়বদ্ধতা বেশি দেখা যায়।
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পিআর বিতর্ক
বাংলাদেশে বর্তমানে বিদ্যমান ফার্স্ট পাস্ট দ্য পোস্ট বা সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোট পদ্ধতিতে সর্বাধিক ভোট পাওয়া প্রার্থীই বিজয়ী হন। তবে রাজনৈতিক মহলে দীর্ঘদিন ধরে সমালোচনা রয়েছে যে এই ব্যবস্থায় প্রকৃত ভোটের প্রতিফলন ঘটে না। যেমন—কোনো প্রার্থী ৩৫ শতাংশ ভোট পেলেও বিজয়ী হতে পারেন, আর বাকি ৬৫ শতাংশ ভোট (অন্যান্য প্রার্থীরা মিলে পেলে) কার্যত ‘অকার্যকর’ হয়ে যায়।
এজন্য জামায়াতসহ কয়েকটি রাজনৈতিক দল দাবি তুলেছে, বাংলাদেশে আংশিক বা পূর্ণ পিআর ব্যবস্থা চালু করা হোক। তাদের যুক্তি, এতে বহুদলীয় গণতন্ত্রের সঠিক প্রতিফলন ঘটবে এবং ভোটাররা তাদের ভোটের পূর্ণ মূল্য পাবেন। তবে বড় দলগুলো মনে করছে, এতে (পিআর) স্থিতিশীল সরকার গঠন ঝুঁকির মুখে পড়বে।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞানের অধ্যাপক ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে কোনো দলের পক্ষে একা সরকার গঠন করা সম্ভব না। এজন্য তার ছোট ছোট দলগুলোর প্রতি নির্ভর করতে হয়। এই সুযোগে অনেক সময় ছোট দলগুলো সরকারকে বেকায়দায় ফেলে দেয়। ইতালি এটার বাস্তব উদাহরণ। কোয়ালিশন (জোট) সরকারেও এমন পরিস্থিতি দেখা যায়।’
বাংলাদেশে পিআর পদ্ধতির চ্যালেঞ্জ
বিশ্বের যেসব দেশে পিআর ব্যবস্থা চালু সেসব দেশে গণতন্ত্রের বৈচিত্র্য ও অন্তর্ভুক্তি বেড়েছে। তবে এর সঙ্গে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও ঘনঘন জোট পরিবর্তনের উদাহরণও কম নয়। উদাহরণস্বরূপ, ইসরাইল ও নেপালে প্রায়ই সরকার পরিবর্তন হয়, কারণ কোনো দল এককভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারে না। অন্যদিকে, জার্মানি তুলনামূলকভাবে স্থিতিশীল, কারণ সেখানে মিশ্র পদ্ধতির মাধ্যমে ভারসাম্য আনা হয়েছে।
বাংলাদেশে যদি পিআর পদ্ধতি চালু হয়, তবে কীভাবে তা বাস্তবায়ন করা হবে—পুরোপুরি নাকি আংশিক মিশ্র ব্যবস্থায়—তা নিয়ে বড় ধরনের বিতর্ক দেখা দেওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে।
ড. সাব্বির আহমেদ বলেন, ‘বাংলাদেশ পিআর পদ্ধতির নির্বাচনের জন্য এখনো প্রস্তুত নয় বলে আমি মনে করি। কারণ বাংলাদেশের রাজনীতির মান এখনো উন্নত নয়। পিআর পদ্ধতিতে দল ঠিক করবে কে এমপি হবে। সেক্ষেত্রে আগে যে ১০ লাখ টাকা দিয়ে দলীয় মনোনয়ন কিনতো, সে তখন ১০০ কোটি টাকা দিয়ে কিনবে। দলও বলবে আপনি আমাকে ১০০ কোটি টাকা দেন আপনাকে মনোনয়ন দেব।’
প্রকৃত রাজনীতিবীদেরা পিআর পদ্ধতিতে মূল্যায়িত হবেন না বলে মনে করেন এই গবেষক। তিনি বলেন, ‘সনাতন রাজনৈতিক ধারায় যারা ফুলটাইম পলিটিক্স করেন, পলিটিক্সই যাদের জীবন-মরণ ওই লোকগুলো তখন আর মূল্যায়িত হয় না। কারণ তাদের তো আর এতো টাকা নাই।’
এই পদ্ধতি ভোট দেওয়ার প্রতি ভোটার আনাগ্রহও তৈরি হবে বলেও মনে করেন এই ঢাবি শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘পিআর পদ্ধতিতে প্রার্থী নির্বাচন করে দল। ভোটারদের তাদের নিজেদের প্রার্থী বাছাই করে নেওয়ার সুযোগ নেই। সেক্ষেত্রে ভোটারদের মধ্যে ভোট দিতে অনাগ্রহ তৈরি হতে পারে।’
আনুপাতিক প্রতিনিধিত্ব গণতন্ত্রকে আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ও বহুমাত্রিক করার সুযোগ দেয়। তবে এর সঙ্গে রয়েছে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার বড় চ্যালেঞ্জ। বিশ্বব্যাপী অভিজ্ঞতা বলছে, প্রতিটি দেশের সামাজিক-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী পদ্ধতিটি কার্যকর বা অকার্যকর হয়ে ওঠে। বাংলাদেশের জন্যও এ বিতর্ক হয়তো নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার দ্বার খুলতে পারে, আবার অস্থিরতার ঝুঁকিও বয়ে আনতে পারে।
পরিশেষে একটি কথা না বললেই নয়, যে দেশে ভোট বিক্রি হয় একটি শাড়ি, লুঙ্গী বা অন্য কোন ভাবে, সেদেশে পিআর পদ্ধতির নির্বাচন দীর্ঘ মেয়াদী সমস্যা তৈরি করবে।